ভারতে হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসারের জন্য আজকের দিনটিকে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি দিবস হিসেবে পালন করছে। ১৯৪৯ সালে ভারতের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান সভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রতি বছর ১৪ সেপ্টেম্বর দিনটি ‘রাজভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে – আর সেই রাজভাষাটি হবে হিন্দি।
সেই ধারাবাহিকতায় সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দিনটিতে রাজভাষা দিবস বা হিন্দি দিবস উদযাপিত হচ্ছে ঠিকই – কিন্তু বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনও অব্যাহত।
ভারতে প্রায় সব কেন্দ্রীয় সরকারই আগাগোড়া যুক্তি দিয়ে এসেছে বহুভাষাভাষী ওই দেশে ‘লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে হিন্দি অপরিহার্য। কিন্তু হিন্দি ভাষাভাষী নয় এমন বহু রাজ্যই পাল্টা দাবি করে থাকে হিন্দিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাদের ভাষাগুলো বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ হিন্দি বা তার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট বা উপভাষায় কথা বলেন, আর এই ভাষাটিকে সারা দেশের প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার তাগিদ চলছে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। আর ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’ যে বিজেপির ঘোষিত রাজনৈতিক এজেন্ডা, তাদের আমলে সেই উদ্যোগ আরও গতি পেয়েছে সহজবোধ্য কারণেই।
এবছরের হিন্দি দিবসের ভাষণেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, “হিন্দিই হল সেই ভাষা যা সমগ্র ভারতকে একতার সূত্রে বেঁধে রেখেছে।”
ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পেছনে হিন্দি ছাড়া আরও সব ভাষার ভূমিকাকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি, কিন্তু সারা দেশে সরকারি কাজকর্ম যে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি হিন্দিতেই হওয়া বাঞ্ছনীয় – সরকারের সেই অভিপ্রায়ও গোপন করেননি।
কিন্তু সব সরকারি দফতর, অফিস-আদালত কিংবা ব্যাঙ্কে হিন্দিকে সরকার মূল ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। যেমন তামিলনাডুর রাজনীতির একটা প্রধান ভিত্তিই হল হিন্দি-বিরোধিতা।
তামিল রাজনীতিবিদ ও এমপি কানিমোঝি মাসখানেক আগেই চেন্নাই এয়ারপোর্টে একজন নিরাপত্তাকর্মীর হিন্দি কথা বুঝতে না-পারায় তার অবাক প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন, “ভারতীয় হয়েও কীভাবে আপনি হিন্দি বুঝতে পারেন না?”
সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে কানিমোঝি বলছিলেন, “একটা বিশেষ ভাষা না-জানলেই যে একজন কম ভারতীয় হয়ে যান না, সেই বোধটাই আসলে দেশের একটা বড় অংশে তৈরি হয়নি!”
হিন্দি যে কেন্দ্রীয় সরকারের বেশি ‘প্রশ্রয়’ পাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যথেষ্ঠ ক্ষোভ আছে পূর্ব ভারতেও। বাংলা ভাষার সুপরিচিত কবি ও ভাষাবিদ সুবোধ সরকার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এটাও আসলে এক ধরনের বঞ্চনা।
সুবোধ সরকারের কথায়, “ভারতের অন্য সব ভাষার প্রতি আমার যতটা ভালবাসা, হিন্দির প্রতিও সেই সমান ভালবাসা আছে – এক চুলও কম নেই।”
“তবে কথা হল, ভারতের চব্বিশটা প্রধান ভাষাকেই কিন্তু অষ্টম তফসিলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে – ফলে সংবিধানের চোখে, সাহিত্য অ্যাকাডেমির চোখে তাদের প্রতিটারই সমান মর্যাদা। তাহলে বাংলা ভাষা দিবস নয় কেন, তামিল ভাষা দিবস নয় কেন?”
“আসলে হিন্দিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বা হিন্দিকে নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে বহু বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিপুল অর্থ খরচ করে আসছে, অন্য ভাষাগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু তার ভগ্নাংশও করা হয়নি।”
“এ কারণেই আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে একটা ভাষা প্রবঞ্চনা তৈরি হচ্ছে”, বলছিলেন সুবোধ সরকার।
তবে হিন্দির সমর্থকরা অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন, এখানে প্রশ্নটা অবহেলা বা বঞ্চনার নয় – ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে একটা অভিন্ন যোগসূত্র দরকার সেটা বাস্তবতা, আর তার প্রধান দাবিদার হিন্দিই।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ গীতা ভাট যেমন বলছিলেন, “ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা আমাদের মধ্যে এমনভাবে শিকড় গেড়েছে যে স্বাধীনতার পরও আমরা বিশ্বাস করে গেছি একমাত্র ইংরেজিই হতে পারে এদেশের অভিন্ন যোগসূত্র।”
“প্রশ্ন হল, একটা স্বদেশি ভারতীয় ভাষা কেন সেই জায়গাটা নিতে পারবে না?”
হিন্দিকে সেই জায়গাটা দেওয়ার জন্যই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে গত সাত দশক ধরে, আর তামিলনাডু-পশ্চিমবঙ্গ-অন্ধ্র বা কর্নাটকের অনেকেই ভাবছেন তাহলে আমাদের তামিল-বাংলা-তেলুগু-কন্নড়ই বা কী দোষ করল?